ঔপনিবেশিক আধুনিকতার নানা রকম একরোখা প্রত্যয় মানুষকে ক্রমাগত একটা চরম হাঁসফাঁস অবস্থার ভিতর ঠেলে দিয়েছিল। আলোকপ্রাপ্তির তত্ত্বর অন্তিম লগ্ন যতই ঘনিয়ে এল সারা পৃথিবী জুড়ে ততই প্রকট হয়ে দেখা দিল সমরাস্ত্রের ঝনঝনা, পারমাণবিক অস্ত্র বানাবার প্রতিযোগিতা, নতুন নতুন জিগির তুলে এলাকা দখল ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই, পরিবেশের দফারাফা করা, সাদা-কালোর বর্ণবৈষম্যবাদ এবং শ্বেতাঙ্গ সমাজের নানান ধরণের সব হামবড়া আস্ফালন। সুতরাং ইউরোপীয় আধুনিকতার যেমন একটা শুরু ছিল তেমনি একটা সমাপ্তিও চিহ্নিত হয়ে গেল। এই উত্তর-ঔপনিবেশিক তথা পোস্টমডার্ন সময়ে এসে মানুষের সামনে বড়ো হয়ে দেখা দিচ্ছে বিশ্বশান্তি, মানুষে মানুষে ঐক্য, সৌভ্রাতৃত্ববোধ, সবার উপরে সামাজিক সুখ ও মানব-কল্যাণ। মানুষ মেনে নিচ্ছে নানা দেশ নানা সমাজ নানা ধর্ম নানা সংস্কৃতির পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে। মেনে নিচ্ছে মানব-সমাজের বহুরৈখিক বিকাশকে। সেই সূত্রে ধর্ম-দর্শন-রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি সমস্ত ব্যাপারেই বাইরে ঝাঁ-চকচকে কিন্তু ভিতরে শ্রীহীন পশ্চিমি আধুনিকতার একদেশদর্শী মনোভাবকে চরম সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে এক বহুত্ববাদী উচ্চারণ। ব্রিটিশ-উপনিবেশের প্রান্তিক-বাংলার প্রায় নিরক্ষর এক মানুষের মুখ থেকে উৎসারিত সেই প্রত্যয়টি আমাদের সকলেরই জানা-- “যত মত তত পথ”-- বহু-উচ্চারিত যে কথাগুলি আজ বচন থেকে প্রবচনে রূপান্তরিত। ধর্ম সম্পর্কে এই বহুবাচনিক অভিমতটি যিনি ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর কথা জানেন না এই বাংলাদেশে এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্ত বিরল। শ্রীরামকৃষ্ণ একই সঙ্গে একটি ঐতিহাসিক চরিত্র এবং একজন কিংবদন্তী পুরুষ। তাঁকে আমাদের ধর্মপ্রাণ ভক্ত-সত্তা অবতারের আসনে বসিয়েছে। সুতরাং তাঁকে নিয়ে কিছু লেখা মানে একই সঙ্গে একটা ইতিহাসের মধ্যে বিচরণ করা এবং দীর্ঘকাল ধরে গড়ে ওঠা সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের ক্ষেত্রটিকে অনাহত রাখা, যে কাজটি মোটেই খুব সহজ সরল নয়। যে কোনো মানুষের জীবন বা কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করা খুব সহজ কাজ নয়। সারা জীবন ধরে একজন মানুষের জীবনে থাকে নানান ওঠা-পড়া, নানান বৃদ্ধি ও বিকাশ, নানান সমস্যা ও সংকট এবং তাদের মোকাবিলা। সেই মানুষটিকে জানতে গেলে তাঁর সেই অতীতকে খুঁজে বের করে তুলে আনার কাজটা তাই শেষ পর্যন্ত বেশ কঠিনই হয়ে পড়ে। আর এই মানুষটি যদি শ্রীরামকৃষ্ণের মতো একজন সাধু-সন্ত হন তাহলে তা আরো কঠিন হয়। কারণ তখন সেই সাধকের জীবনী শুধুমাত্র একজন মানুষের জীবনী থাকে না, তার সঙ্গে যেমন জড়িয়ে যায় ভারতবর্ষের মতো একটি দেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তেমনি তার মধ্যে মিশে থাকে কোটি কোটি মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, ভক্তি ও বিশ্বাস। রামকৃষ্ণ সম্পর্কে লিখতে বসে প্রথমেই যে কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে তা হল রামকৃষ্ণ ছিলেন রামকৃষ্ণই, তাঁর চেয়ে এক ইঞ্চি কমও নন, তাঁর চেয়ে দু-ফুট বেশিও নন।এই মানুষটি সম্পর্কে দেশে-বিদেশে গত প্রায় সোয়াশো বছরেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা ও লেখালিখি কিছু কম হয়নি, এখনও হচ্ছে সমানে। প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো চেষ্টা করেছেন ও করে চলেছেন রমকৃষ্ণের অ-সাধারণত্বকে স্বীকার বা অস্বীকার করতে এবং নিজের নিজের মতের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে। ফলে এ নিয়ে প্রচুর ব্যাখ্যাও হাজির হয়েছে এবং আরো হবে। কারণ শ্রীরামকৃষ্ণদেব এমনই একজন মানুষ যাঁর কাজকর্মকে ব্যক্তিগত ভাবে কারো পছন্দ হোক বা না হোক, হাজার চেষ্টা করে কোনো মতেই তা অস্বীকার করা যায় না বা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তাঁর কথা জানার পর একজন মানুষকে নিজের কাছে নিজের মতো করে স্বীকার বা অস্বীকারের একটা যুক্তি-কাঠামো সাজিয়ে রাখতেই হয়, নাহলে তাঁকে ভুগতে হয় অস্তিত্বের সংকটে। আমরা যতই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মডার্ন-পোস্টমডার্নের দ্বন্দ্বগুলিকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করি বা সেগুলিকে প্রকাশ করে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে চরিতার্থ করতে চাই না কেন, রামকৃষ্ণের প্রসঙ্গ এলে কিন্তু সে সবকিছুকেই একেবারে জোলো মনে হয়। কারণ তখন যাবতীয় যুক্তি-তর্ক-ব্যাখ্যা খুব তুচ্ছ মনে হয় এবং তখন মানুষকে মাপার জন্যে মানুষেরই তৈরি করা এই ধরণের কোনো মানদণ্ড দিয়েই আর শ্রীরামকৃষ্ণকে ছোঁয়া যায় না। অনেকে রামকৃষ্ণকে উনবিংশ শতকের বাবু-কলকাতার বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের একজন হিসেবে চিহ্নিত করে, রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়ে এবং কিছু ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করে তাঁর ঐতিহাসিক পটভূমিকা বিচার করতে চান। কিন্তু সেটি সেই ব্যক্তির একেবারেই একপেশে এবং সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রকাশ করে। কারণ রামকৃষ্ণ এমনই একজন মানুষ যাঁকে বুঝতে গেলে তাঁর পারিবারিক, সামাজিক এবং তাঁর সময়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট অর্থাৎ তাঁর জন্ম, তাঁর বেড়ে ওঠা, তাঁর মাটি-শেকড়-জলহাওয়া থেকে শুরু করে এই বঙ্গভূমির সমকালীন এবং আবহমান ধর্মচেতনা যতটা সম্ভব জানা ও বোঝার চেষ্টা করতে হবে, এবং কিছুটা হলেও বিশ্বব্যবস্থার চালচিত্রটকেও নজরে রাখতে হবে। আমরা জানি, রামকৃষ্ণ জন্মেছিলেন ১৮৩৬ সালে হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে। কলকাতা থেকে সে গ্রাম ছিল বহু যোজন দূরে। আমরা এও জানি যে-পরিবারে রামকৃষ্ণ জন্ম হয়েছিল তা ছিল এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবার। শুধু এটুকু বললেই শেষ হয় না, কারণ নামে ব্রাহ্মণ হলেও শ্রীচৈতন্য-পরবর্তী বৈষ্ণব-ধর্মের অপরিসীম প্রভাবে তখন সারা বাংলাদেশের মতো সেই পরিবারেও প্রাতিষ্ঠানিক ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের ভিত ছিল নিতান্ত আলগা, তবু সত্য-নিষ্ঠার প্রতি সেই পরিবারের আনুগত্য কিছু কম ছিল না। কারণ আদালতে মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে রাজি না-হওয়াতে সেই পরিবারের গৃহকর্তাকে স্থানীয় জমিদারের রোষে তাঁর পৈতৃক দেরে গ্রাম ছেড়ে সপরিবারে কামারপুকুরে এসে নতুন করে সংসার পাততে হয়েছিল। তার মানে রামকৃষ্ণের ছেলেবেলায় তাঁকে বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের জবরদস্ত আবহের মধ্যে পড়তে হয়নি। বরং সেই পরিবারে বেশ কতকটা বৈষ্ণব উদারতা ছিল। কামারপুকুর গ্রামের ক্ষুদিরাম চাটুজ্যে এবং চন্দ্রমণিদেবীর এই সন্তানের প্রথাগত কোনো বিদ্যাশিক্ষা প্রায় ছিল না বললেই চলে। তখন তার কোনো দরকারও ছিল না। কারণ পারিবারিক বৃত্তি যখন পুরুতগিরি, তখন কোনো রকমে পুজোপাঠটা শিখে নিতে পারলেই এই সমস্ত পরিবারের দিন চলে যেত। আর তাছাড়া প্রথাগত কোনো শিক্ষার প্রতি ঠাকুরের কোনো কালেই কোনো রকম আগ্রহই তৈরি হয়নি। সুতরাং ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হবার সুবাদে বড়ো বড়ো পুঁথি-পুরাণ পড়ে রামকৃষ্ণকে ধর্ম সম্পর্কে চাপিয়ে দেওয়া জ্ঞান-লাভের পথে হাঁটতে হয়নি। তাঁকে বাধ্য হয়ে সনাতন হিন্দুত্ববাদী কোনো চিন্তাভাবনা ও কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হতে হয়নি। তাঁর যেটুকু শিক্ষা সবই গ্রামীণ কথকতা, যাত্রাপালা, কীর্তন, কবিগান এই রকম সব লোকায়তিক মাধ্যমের আসর থেকে। পাঠক হয়ত জিগ্যেস করতে পারেন, এই সব কথা আমি বলছি কেন? এর থেকে কি শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে কোনো নতুন তথ্য উঠে আসবে? হয়ত আসবে, হয়ত আসবে না। কিন্তু আমি যে বিষয়টার উপর এখন মনোযোগ দিতে চাইছি তা হল যে কোনো রকম ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে শত হস্ত দূরে থাকা রামকৃষ্ণের ঈশ্বর সাধনার মূল যে ভিত্তি সেই নিখাদ বিশ্বাস ও ভক্তির উৎসমুখ ও পরিপুষ্টির শেকড়-সন্ধান। আসলে রামকৃষ্ণ এমন একজন মানুষ যিনি নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ, সহজ-সরল, সততা-ঋদ্ধ। তাঁর মধ্যে কোনো ছলনা নেই, কপটতা নেই, চালাকি নেই, ভণ্ডামি নেই, দ্বিচারিতা নেই, অলৌকিকতা বা ভেলকিবাজি দেখানোর মিথ্যে চেষ্টা নেই, আড়ম্ভর নেই, ঢাক পিটোনো নেই, অহংকার নেই, কর্তৃত্ববাদ নেই, মাতব্বরি নেই।নিতান্ত সাধারণ হয়েও তাই তিনি শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেন অত্যন্ত অসাধারণ। এর পাশাপাশি যদি সেই সময়ের নাগরিক সমাজের দিকে নজর ঘোরানো যায় তাহলে দেখা যাবে সমাজের এগিয়ে থাকা অংশের মানুষের মধ্যে তখন ক্রমশই যেমন বাড়ছিল ইংরেজী শিক্ষা, তেমনি একটু একটু করে জমা হচ্ছিল পরাধীনতার গ্লানি বোঝার অনুভূতি। ক্রমশই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও দীক্ষিত হতে থাকা শহর কলকাতার মানুষজনের মধ্যে তখন একদিকে সূচিত হয়েছে নিজের সত্তাকে জানা ও চেনার পর্ব অন্যদিকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ঔরসে জন্ম নেওয়া মধ্যসত্ত্বভোগী বাঙালিদের বৃত্তে তখন ঘটে চলেছে বাবু-কালচারের সাড়ম্ভর উত্থান। একই সঙ্গে দেখুন তখন সাগরপারে তথাকথিত আলোকপ্রাপ্তির পরিমণ্ডলে তখন যুক্তি, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের কী বিপুল রমরমা। সেই সঙ্গে সেই যুক্তি-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে দোসর বানিয়ে অহংকারী ও চরম নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার কী অপ্রতিহত অগ্রগতি। যাকে তখন ঢাক পিটিয়ে বলা হচ্ছে সভ্যতার অগ্রগতি। চিন্তা করলে অবাক হতে হয় বস্তু-বিশ্বে যুক্তি-বিজ্ঞান ও উপনিবেশবাদের সেই চরম উন্নতির দিকে পরবর্তী সময়ে যে মানুষটির পরম বিশ্বাস ও ভক্তি-নির্ভর কাজকর্ম ও চিন্তা-ভাবনা এক কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল এবং দেশের ও বিদেশের আপামর জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করল, ব্রাহ্মণ-বৈষ্ণব পরিবারের সেই সন্তান তখন প্রান্তিক বাংলার অখ্যাত হাটে-বাটে আশ মিটিয়ে প্রকৃতিকে উপভোগ করছেন, ঠাকুর-দেবতাদের লীলা বুঝতে গ্রামীণ কথকতার আসরে মনের আনন্দে সময় কাটাচ্ছেন। আবার কখনো বা পাশে লাহাদের বাড়ির অতিথিশালায় আশ্রয় নেওয়া শ্রীক্ষেত্রগামী সাধুদের কাছে বসে এক মনে ধর্ম আলোচনা শুনছেন। সেখানে রামমোহন-বিদ্যাসাগর-ডিরোজিওর আন্দোলনের সামান্যতম ঢেউও কোথাও নেই। এখন আমরা যদি এই বাংলাদেশের তৎকালীন ধর্মীয় পরিমণ্ডলটির দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা একই সঙ্গে লোক-সমাজের আর্যায়ন এবং আর্য-সমাজের লোকায়ন প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে সনাতন হিন্দুধর্মের প্রধান নেতিবাচক যে দিক সেই জাতিভেদ-প্রথা ও অস্পৃশ্যতাকে অতিক্রম করে তলে তলে ঘটে গেছিল এক মানবিক উত্থান ও সর্ব সর্বধর্ম-সমন্বয়। মঙ্গলকাব্যের মহা-আখ্যানগুলির মাধ্যমে আমরা জানতে পারি কয়েকশো বছর আগে লোক-সমাজে বিভিন্ন ধর্মগুলির ভিতর একটা বিরোধিতা ও বিরূপতার ভাব ছিল। বিশেষ করে যে সব লোকায়ত দেব-দেবী অল্পদিন হল সনাতন ধর্মের শরীরে অঙ্গীভূত হয়েছিল সেই মনসা, চণ্ডী, ধর্ম, শীতলা প্রভৃতির অনুরাগীদের মধ্যে। তারপর চৈতন্যদেব তাঁর অননা-সাধারণ ছোঁয়ায় প্রেমকে ধর্মে রূপান্তরিত করে নিলেন। সেই প্রেমধর্মের জোয়ারে একসময় সারা বঙ্গভূমি হাবুডুবু খেল। বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতিতে এই চৈতন্যধর্মের সর্বব্যপী অথচ নীরব প্রভাব অনুভব করে বিশেষজ্ঞরা তার নাম দিলেন চৈতন্য-রেনেসাঁ। কিন্তু চৈতন্যদেবের তিরোধানের পর তাঁর অনুপস্থিতিতে সেই প্রেমধর্মের খানিকটা দেহবাদী সাধন-ভজনের দিকে চলে গেল এবং বাকিটা গ্রাস করেছিল সেই সময়ের প্রতিষ্ঠানবাদী ব্রাহ্মণ্যধর্ম যাঁরা প্রথমে চৈতন্যদেবের ভাব-আন্দোলনের সর্বতোভাবে বিরো্ধিতা করেছিলেন। কিন্তু পরে শ্রীগৌরাঙ্গের বিপুল জনপ্রিয়তাকে হিন্দুধর্মের পক্ষে আনার জন্যে হিন্দু-ধর্মের কর্তা-ব্যক্তিরা খুব সংগঠিত ভাবে চৈতন্যদেবকে রাধা ও কৃষ্ণের যুগল অবতার আখ্যা দিয়ে বোঝাতে চাইলেন চৈতন্যদেবের ধর্ম-প্রচার জাতপাতের গন্ধমুক্ত যে নতুন ধর্মের কথা বলেছেন তা আসলে সনাতন হিন্দু ধর্মেরই অংশমাত্র। অথচ, যাঁরা ধর্ম ও ইতিহাসের সামান্যতম খোঁজ-খবরও রাখেন তাঁরা জানেন এই দাবি কতখানি অবান্তর। সময় যেমন কখনো এক জায়গায় থেমে থাকে না, এই বঙ্গভূমিতে সাধারণ মানুষের ধর্ম-চর্চাও তেমনি কখনোই কোনো বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়নি। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে বারে বারে নিজেকে যুগোপযোগী করে নিয়েছে। তাই লোকধর্মের একটা বড়ো অংশ একসময় দেহবাদ থেকে উত্তীর্ন হয়ে আরো বেশি মানসিক ও মানবিক হয়ে উঠল। বেদ-বেদান্তের জ্ঞান ও কর্মকে আলবিদা জানিয়ে লোকায়তিক প্রেম ও ভক্তির সঙ্গে যুক্ত হল বাৎসল্য রস। বাংলার শস্য-শ্যামল প্রান্তরে ক্রমশই প্রবল হয়ে উঠল শাক্তধর্ম। আগমনী-বিজয়ার গান থেকে শুরু করে শ্যামা-সংগীতের কথা ও সুরে মুখরিত হল নদী-মাতৃক এই দেশের মাঠ-ঘাট আকাশ-বাতাস সব কিছু। শ্রীচৈতন্য-প্রেমের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে ক্রমশ প্রান্ত-বাংলার মানুষদের মধ্যে উগ্র ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক বৈরিতা হীনবল হয়ে গেছিল। সাধারণ লোকসমাজে বৌদ্ধ, জৈন, সৌর, শৈব, নাথ, শাক্ত, বৌষ্ণব, তান্ত্রিক, বাউল, ফকির, দরবেশ এঁরা সব হয়ে গেছিলেন মিলেমিশে একাকার। এমনকি সত্য-পীরের মাধ্যমে ম্লেছ বলে কথিত মুসলিমদের সঙ্গেও একটা মানিয়ে নেবার প্রবল চেষ্টা জারি ছিল। এই ভাবে সব মিলিয়ে ধর্ম-কর্মের ব্যাপারে তখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সামগ্রিকভাবে তৈরি হয়েছিল একটা সার্বিক সমন্বয় ও সহিষ্ণুতার ভাব। পরবর্তীকালে শ্রীরামকৃষ্ণ বলে যিনি পরিচিত হলেন, ধর্মের ব্যাপারে সেই মানুষটির বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে ওঠার পিছনে বঙ্গভূমির এই ধর্মীয় পরিমণ্ডলটির প্রভাব ভুলে গেলে বা অস্বীকার করলে আমার মনে হয় রামকৃষ্ণকে জানার ক্ষেত্রে আমাদের একটা বিশাল বড়ো ঘাটতি থেকে যাবে। আরো একটা কথা আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে গদাধর থেকে ক্রমশই রামকৃষ্ণ হয়ে ওঠা সেই মানুষটির ছিল ঈশ্বরের প্রতি এক নিটোল বিশ্বাস, ভক্তি ও প্রেম। একজন মানুষ যখন ছোটো থেকে বড়ো হয়, দেহ ও মনে সে ক্রমশই পরিণতি লাভ করে, একটু একটু করে তাঁর মন নানা সত্তায় বহু-বিভক্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির পর বিকশিত হয় তাঁর পুরুষ সত্তা অথবা নারী সত্তা। একজন পুরুষের বেলায় তার সঙ্গে লীন হয়ে থাকে সন্তান-স্বামী-প্রেমিক-পিতা-ভাই-বন্ধু-প্রতিবেশী এই রকম নানান সব সামাজিক সত্তা তাঁর উপর প্রভু-সত্তা, মালিক-সত্তা, কর্মী-সত্তা, শ্রমিক-সত্তা, শাষক-শোষিত-অত্যাচারী-অত্যাচারিত এই ধরণের অজস্র অস্তিত্ত্ব। কিন্তু রামকৃষ্ণের ছিল একটাই সত্তা। সেই সত্তার নাম ভক্তসত্তা। রামকৃষ্ণের মধ্যে চূড়ান্ত বিকশিত সেই ভক্তি একজন সন্তানের ভক্তি। আশ্চর্য তাঁর মধ্যে অন্য কোনো সত্তার বিকাশ একেবারেই চোখে পড়ে না। সুতরাং রামকৃষ্ণের জীবন কাজকর্ম এবং বাণী বা উপদেশের মধ্যে দিয়ে বিচরণ করলে রামকৃষ্ণের যে বিশেষত্বটি বার বার চোখে পরে তা হল তাঁর মধ্যে সব সময় জাগ্রত এই রকম এক সহজ সরল ভক্তি ও বিশ্বাস। তাঁর এই ভক্তি ও বিশ্বাস এত অখণ্ড ও নিটোল যে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং জীবনের নানান ঘাতে-প্রতিঘাতে দ্বিধাদীর্ণ সংশয়াকুল বিভ্রান্ত অন্যান্য মানুষজনের কাছে তা নিতান্ত অবাক হবার বিষয়। আমরা দেখেছি বা জেনেছি প্রথম জীবনে রামকৃষ্ণের মধ্যে কিছুটা চঞ্চল ভাব ছিল। তাঁর মধ্যে সেই অস্থিরতা এসেছিল কারণ ঈশ্বরের সাধনা কোন পথে দিন-রাত তারই চিন্তা করে, নিজের সমস্ত শক্তি ও কর্ম দিয়ে শরীর-মন এক করে তারই খোঁজ করতে গিয়ে তিনি একই মত ও পথে নিজেকে লগ্ন রাখতে পারেননি। ১৮৫২ সালে বড়ো দাদা রামকুমারের হাত ধরে কলকাতায় আসার পর সাধনার মাধ্যম হিসেবে তিনি সব রাস্তাকেই বাজিয়ে দেখেছেন। কলকাতায় আসার পর তিনি কিছুদিন এ-বাড়ি ও-বাড়ি পুরুতগিরি করেছেন। ১৮৫২ সালে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি স্থাপিত হলে রামকুমার সেখানকার পুরুত নিযুক্ত হন। গদাধর পেলেন ভবতারিণী কালীমূর্তিটিকে সাজানোর ভার। ১৮৫৬ সালে দাদার মৃত্যুর পর তিনি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির পুরুতের দায়িত্ব পেয়েছেন। সেখানে কালীমূর্তির দিকে তাকিয়ে শুধু ধ্যান করেননি, অনবরত প্রশ্ন করে গেছেন ‘আমি কি এক টুকরো পাষাণকে পুজো করছি না কোনো জাগ্রত দেবীকে’। ‘দেখা দে, দেখা দে মা’ বলে রাতদিন তিনি আকুল প্রার্থনা করেছেন। অবশেষে নিজের বিশ্বাসের জগতে একসময় জগৎমাতাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই সময় তিনি পাগলের মতো আচরণ করেছেন, হাউ হাউ করে কেঁদেছেন। বাড়ির লোকেরা তাঁর সেই অস্বাভাবিক হাব-ভাবের খবর পেয়ে তাঁকে সংসারে থিতু করার জন্যে গ্রামে নিয়ে গিয়ে ১৮৫৯ সালে ২৩ বছরের গদাধরের সঙ্গে পাঁচ-বছরের সারদামণির বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। নিজের বিশ্বাসের জগতে তাঁর আরাধ্য দেবী কালীর দেখা পাবার পরেও কিন্তু রামকৃষ্ণ ঈশ্বর সাধনা থামিয়ে দেননি। বিয়ের আগে কিছু সময় ধরে তিনি দাস্যভাবে রামের সাধনা করেছেন। তারপর বিয়ের পরে একে একে তিনি ১৮৬১-তে ভৈরবী-ব্রাহ্মণীর কাছে যেমন যোগ ও তন্ত্রের সাধনা করেছেন এবং তন্ত্র-সাধনার ৬৪টি পথেই বিচরণ করেছেন (শুধু পঞ্চ-ম-কারের দুটোকে বাদ দিয়েছেন)। তেমনি ১৮৬৪-তে বৈষ্ণব-গুরু জটাধারীর কাছে নানান বৈষ্ণবভাবের সাধনা করেছেন, কারণ বৈষ্ণবভক্তিতেও তাঁর ছিল অগাধ আস্থা, তিনি মনে করতেন ভগবানকে পাবার সেটাও একটা ভাল উপায়। তিনি যেমন দাস্যভাব অভ্যাস করেছিলেন তেমনি তিনি বাৎসল্যভাবের সাধনাও করেছিলেন, আবার তিনি শান্ত, সখ্য বা মধুরভাবেও বিচরণ করেছেন। তিনি কিছুদিন সেবা করেছেন ধাতব রামলীলার মূর্তিকে। এক সময় ঘুরে এসেছেন নবদ্বীপধাম। পরে তিনি ১৮৬৫-তে সন্ন্যাস গ্রহণ করে নাগা সন্ন্যাসী তোতাপুরীর কাছে ১১ মাস ধরে অদ্বৈত্ব-বেদান্ত অভ্যাস করেছেন আবার ১৮৬৬-তে সুফি-সাধক গোবিন্দ রায়ের কাছে মুসলিম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে তিন দিন ধরে আল্লার সাধনা করেছেন। ১৮৭৩-এর শেষের দিকে তিনি আবার তাঁর ভক্ত শম্ভুচরণ মিত্রের কাছে বাইবেল শুনে বেশ কিছুদিন ধরে যিশুর আরাধনাও করেছেন। রামকৃষ্ণের এই বহুরৈখিক সাধনার মধ্যে কোনো দ্বিচারিতা নজরে পড়ে না। যখন তিনি যে ভাবের সাধনা করেছেন তখন সেই ভাবেই অকৃত্রিম অনুগত থেকেছেন। দাস্য ভাবে রামের সাধনা করতে গিয়ে হনুমান সেজেছেন, রাধা বা সখীভাবের সাধনা করতে গিয়ে মহিলার বেশে থেকেছেন, আল্লার সাধনা করতে গিয়ে কদিন ধরে আর মন্দিরমুখো হননি বা তাঁর প্রিয় ভবতারিণীর মুখদর্শন করেননি, আরব মুসলমানের পোশাক পরে নিষ্ঠাবান মুসলিমের মতো পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়েছেন। যিশু ভজনা করতে গিয়েও তিনি শুধু যিশু ছাড়া অন্য দেব-দেবীর চিন্তাকে মনে জায়গা দেননি।তাঁর সাধনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি বিশ্বাসে ভর করে নিজস্ব ভাব-সমাধির মধ্যে নিজের মতো করে ঈশ্বরের সঙ্গ লাভ করেছেন। তাঁর জীবনী থেকে দেখা যাচ্ছে রামকৃষ্ণের ঈশ্বর-দর্শনের মাধ্যম যে ভাব-সমাধি সেই প্রক্রিয়াটিরও একটি ধারাবাহিকতা আছে। বাল্যকালে ছিল তাঁর প্রকৃতি প্রেম। মাত্র ছ-বছর বয়সে গ্রামের ধানমাঠের আলপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তিনি দেখলেন ঘনকালো মেঘের নীচ দিয়ে এক পাল সাদা বক উড়ে যাচ্ছে। এই অসহ্য-সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হল। তারপর কৈশোরে তাঁর মধ্যে এলো ঈশ্বর-প্রেম। বিশালক্ষ্মীর পুজো করতে করতে বা শিবরাত্রির রাত্রে গ্রামের যাত্রাপালায় শিব সাজতে গিয়ে ভাবের ঘোরে তিনি সংজ্ঞা হারিয়েছেন। দক্ষিণেশ্বরে তিনি যেমন মা-ভবতারিণীর দেখা পেয়েছেন, তেমনি হনুমান সেজে দাস্যভাবে রামের সাধনা করতে গিয়ে নিজের শরীরে তি্নি সীতার রূপদর্শন করেছেন, আবার বাৎসল্য-ভাবে রামলালার মূর্তির মধ্যে তিনি বালক-রামের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করেছেন। নবদ্বীপে গিয়ে তিনি বালক-বেশে নিতাই-গৌরকে স্বদেহে লীন হয়ে যেতে দেখেছেন। বৌষ্ণব-ভাবের সাধনায় সবিকল্প-সমাধিতে তিনি মিলিত হয়েছেন কৃষ্ণের সঙ্গে । আবার বেদান্ত-ব্রহ্মের সাধনায় নির্বিকল্প-সমাধিতে বার বার তিনি ব্রহ্মকে অনুভব করেছেন। এই ভাবে ইসলাম ও ক্রিশ্চান-ভাবের সাধনায় তিনি আল্লা ও যিশুর দেখাও পেয়েছেন। এসবই কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নিটোল বিশ্বাসের জায়গা। অর্থাৎ যখন যে ভাবের সাধনায় তিনি করুন না কেন, তাঁর সব সাধনার উৎসমূলেই কিন্তু ছিল এক অকৃত্রিম বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই শেষ-পর্যন্ত তিনি বেছে নিয়েছিলেন এবং অনুগত থেকেছিলেন সেই ভক্তিমার্গেই। অনেক সময় অন্য মানুষেরা যেটা করেন তা হল নিয়ন্ত্রণের নামে অনেক সত্তাকে গলা টিপে হত্যা করে বা পিটিয়ে মেরে ফেলে ব্রহ্মচারী হতে চান। কিন্তু রামকৃষ্ণের বেলায় কোনো জোর-জবরদস্তি ছিল না। কোনোকিছুই চাপিয়ে দেওয়া ছিল না। তাঁর সবটাই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও সহজাত। শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে যে কয়েকটি চেতনার যুগপৎ সমাবেশ ঘটেছিল সেগুলি হল প্রকৃতি-চেতনা, সৌন্দর্য-চেতনা এবং ঈশ্বর-চেতনা। তাঁর মধ্যে আরো ছিল এক নিরবিচ্ছন্ন খোঁজ। সে খোঁজ সত্যের, সে খোঁজ ঈশ্বরের, সে খোঁজ এক মহাশক্তির। আর সেই খোঁজের ভিত্তিভূমি অবশ্যই এক নিটোল বিশ্বাস। সে বিশ্বাসের চালিকাশক্তি ব্যক্তিমানুষের আধ্যাত্মিক-মানস। রামকৃষ্ণ বললেন প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আছে সেই দৈবীশক্তি। তিনি বললেন যত্র জীব তত্র শিব। তাই আমাদের জীবে দয়া না করে শিবজ্ঞানে জীব সেবা করতে হবে। আধুনিক ইউরোপের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বিপরীতমুখী দুই সত্তার মধ্যে সবসময় এক দ্বন্দ্ব-চেতনাকে আবিষ্কার করা। চেতনার সেই ভ্রান্তি থেকেই আধুনিকতা যেমন বিজ্ঞানের সঙ্গে ধর্মের ঝগড়া বাধিয়ে দিতে চেয়েছে, তেমনি উসকে দিয়েছে ধর্মের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ । সে বলেছে সত্যের ব্যাপারে বিজ্ঞানই শেষকথা বলে এবং ধর্মকে সে তুলনা করেছে আফিং-এর সঙ্গে । কিন্তু এই পোস্টমডার্ন কালখণ্ডে এসে মানুষ অনুভব করছে একজন সেরা বিজ্ঞানী প্রকৃত সত্য-সন্ধানী হবেন এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু তিনি যে মানুষের অন্তর্নিহিত পাশবিকতাকে বিনাশ করে তার মধ্যে সাধুতার ভাব জাগিয়ে তুলতে পারবেন এমনটা কখনোই নয়। আর শুধু বিজ্ঞান কেন – ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপই এই কাজে সক্ষম হবে না। ধর্ম তাই বিজ্ঞান বা অনা কোনো কিছুর বিরোধী নয় বরং সবকিছুরই সে পরিপূরক। আবার অন্যদিকে এই সময়ে এসে আরো বোঝা যাচ্ছে প্রতিটা ধর্মের মধ্যেই নিজের মতো করে সত্যকে জানার চেষ্টা আছে এবং সকল ধর্মের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অজস্র মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, বিশ্বাস। সুতরাং কোনো ধর্মকে কোনোভাবে খাটো করার চেষ্টা মানেই অগণিত মানুষের সেই আবেগ ও ভালোবাসাকে আহত করা। যা করাটা কোনো রকম মহত্বের কাজ হতে পারে না। আবার যদি হিন্দুধর্মের মধ্যে চোখ ডোবানো যায় তাহলে দেখা যাবে সেখানেও দ্বৈত-অদ্বৈত-সাংখ্য-বৌদ্ধ-জৈন এই রকম নানা মত, নানা পথ। তাই সত্যের খোঁজ করতে গিয়ে শংকরাচার্যের মতো রামকৃষ্ণ কিন্তু ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’ বলে জগৎকে উপেক্ষা করে ব্রহ্মের সন্ধানে নিজেকে মগ্ন রাখেননি। নিত্য ব্রহ্মের পাশাপাশি তিনি সমান আগ্রহে মায়াময় এই অনিত্য-লীলার জগৎকেও গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন আসলে তারা একই সত্যের দুটো দিক। মায়াকে তিনি আবার দু-ভাগে ভাগ করেছেন। মানুষের জীবনের সব নেতি-বাচক আবেগগুলির তিনি নাম দিয়েছেন অবিদ্যামায়া। তিনি বলেছেন মানুষের এই সব অবিদ্যামায়া যেমন কাম-ক্রোধ-লোভ-লালসা-হিংসা-নৃসংসতা-- এগুলি মানুষের চেতনার খুব নিচু স্তর। এর বিপরীতে মানুষের যে সব ইতিবাচক গুণ যেমন-- প্রেম-ভক্তি-দয়া-পবিত্রতা, রামকৃষ্ণ তাদের নাম দিয়েছেন বিদ্যামায়া। তিনি জনিয়ে দিয়েছেন এই বিদ্যামায়া মানুষের উচ্চস্তরের চেতনা, তারা মানুষকে আলোকিত করে, পরিশুদ্ধ করে। মানুষকে তারা আধ্যাত্মিক ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করে। আবার আধুনিকদের মতো শ্রীরামকৃষ্ণ দুই বিপরীতমুখি মায়ার মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দিতে চাননি। বরং বিনির্মানের পথ-প্রদর্শক হিসেবে এক তৃতীয় সত্তার কথা বলেছেন। তাঁর মতে বিদ্যামায়া দিয়ে অবিদ্যা মায়াকে অতিক্রম করেই মানুষকে মায়াতীত হতে হবে। ঈশ্বর প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে সারা জীবন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে তিনি সেই মহাশক্তির সাধনা করেছেন। ঈশ্বরের কথা বলেছেন। ঈশ্বর-ভাবনায় ভাবিত হয়ে কাজ করেছেন। সাধনার জন্যে অকৃত্রিম বিশ্বাসের সঙ্গে বেছে নিয়েছেন নানান ধর্মীয় পথ এবং প্রত্যেক পথেই ধরা পড়েছে তাঁর অনায়াস সাফল্য। অর্থাৎ তিনি স্পর্শ করেছেন সেই চূড়ান্ত আধ্যাত্মিক বিন্দুটিকে সব ধর্মেরই যা অন্তিম গন্তব্য। সুতরাং একথা বলা যায় যে এক দৈব অনুভূতি তাঁর মধ্যে সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে কাজ করেছে। তিনি আধ্যাত্মিকতার যে মাত্রাটিকে স্পর্শ করেছেন সেখানে সব পথ সব মত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তাই তাঁকে সনাতন ধর্মের বড়োকর্তারা একটা বিশেষ ধর্মীয় পরিসরে আটকে রাখতে চাইলেও, শেষ হর্যন্ত তন্ত্র মন্ত্র পুজো-আচ্চা ধর্ম-দর্শন ন্যায়-নীতি ভক্তি-প্রেম যুক্তি-তর্ক এসব পরিচিত মাত্রার কোনো কিছু দিয়েই তাঁকে বাঁধা যায়নি। সব কিছুর উপরে তিনি এক সহজ-সাধক, স্বভাব-সাধক হয়ে সারা পৃথিবীর মানুষকে শুনিয়েছেন ধর্মের নতুন বার্তা। সেই বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন তাঁরই সুযোগ্য শিষ্য বিবেকানন্দ, যে কারণে গুরু-শিষ্য সম্পর্কে রম্যাঁ রঁল্যা যে মন্তব্যটি করেছিলেন সেই ‘Prophets of New India’-কে কিছুটা বদলে নিয়ে বলা যায় ‘Prophets of New World’. পার্থিব জীবনে ধর্মীয় পরিসরে একজন মানুষ যা হতে চান রামকৃষ্ণের ভিতর তার পূর্ণ বিকাশ দেখা গেল, তাঁর মধ্যে বিকশিত সেই ঈশ্বরীয় ব্যক্তিত্বের চৌম্বক-শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে সেই নতুন-সত্তার-উন্মোচনের সময়কার সমাজের সর্বস্তরের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা ধর্মবেত্তা বিজ্ঞানবেত্তা মানবদরদী মানবতাবাদী সকল ধর্মের সকল জাতির যাঁরা সত্য-সন্ধানী, দলে দলে সেই সব মানুষ তাঁর কাছে ছুটে এলেন। এতদিন যাঁরা মূর্তি-পূজার বিরোধী ছিলেন সেই ব্রাহ্মদের অন্যতম নেতা, ক্যাথলিক ধর্মমতের প্রতিও যাঁর অনুরাগ সুবিদিত, সেই কেশবচন্দ্র সেন পর্যন্ত তাঁর সাঙ্গ-পাঙ্গ সমেত শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত হয়ে গেলেন। অন্যান্য ব্রাহ্ম-নেতারা যেমন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, শিবনাথ শাস্ত্রী, গিরিশ্চন্দ্র সেন তাঁরাও শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি পরম আনুগত্য দেখিয়ে কলকাতার তৎকালীন শিক্ষিত ও অভিজাত মহলে তাঁর বাণী প্রচার করলেন, রামকৃষ্ণের উপর বই লিখলেন। সেই সময়ের নতুন প্রজন্মের মধ্যে রামকৃষ্ণ প্রবল ভাবে জনপ্রিয় হলেন। ১৯৩৭ সালে রামকৃষ্ণ জন্মশতবার্ষিকীতে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে যে বিশ্বধর্ম সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল তার সভাপতি হিসেবে তৃতীয় দিনে ৩ মার্চ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, যিনি পারিবারিক সূত্রে ব্রাহ্ম ছিলেন, যে অভিভাষণটি দিলেন তাতে শ্রীরামকৃষ্ণের বন্দনা করে তিনি বললেন - বহু সাধকের বহুসাধনার ধারা ধেয়ানে তোমার মিলিত হয়েছে তারা। তোমার জীবনে অসীমের লীলাপথে নূতন তীর্থ রূপ নিল এ-জগতে। দেশ-বিদেশের প্রণাম আনিল টানি সেথায় আমার প্রণতি দিলাম আনি। রামকৃষ্ণকে চিহ্নিত করা হয়েছে উনবিংশ শতকে সনাতন হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের পথিকৃত হিসেবে এবং বাঙালি তথা ভারতীয়দের জাতীয় সত্তার জাগরণের অন্যতম প্রধান অগ্রদূত হিসেবে। আসল মজাটা এইখানে। সেই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজে আকাট গ্রাম্য এবং প্রায় নিরক্ষর এক ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান তাঁর নিজস্ব পরিচয়ে যে ভাবে আলোকিত হলেন তার পিছনে আছে প্রান্ত-বাংলার ঐতিহ্য ও পরম্পরার এক অফুরন্ত প্রাণশক্তি। এটা অস্বীকার করা যায় না যে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ছোঁয়া পেয়ে আচার-সর্বস্ব এবং কুসংস্কারের শৈবালদামে বদ্ধ-ডোবায় পরিণত হওয়া সনাতন ধর্মের শরীরে এক নতুন প্লাবনের সূচনা হল। তার পাশাপাশি এটাও স্বীকার করে নিতে হয় রামকৃষ্ণ যে ধর্মের বাণী প্রচার করলেন তাকে আবার ঠিক হিন্দুধর্ম বলা যায় না। কারণ বৈদিক-ব্রাহ্মণ্য ভাবধারায় পরিপুষ্ট হিন্দুধর্মেরই যে দুটি প্রধান নেতিবাচক দিক সেই জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতাকে শ্রীরামকৃষ্ণ আমল দিলেন না। তিনি বললেন জাতিধর্ম-নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আছে ঈশ্বরে উপস্থিতি, সুতরাং মানুষকে বাদ দিয়ে ঈশ্বর হয় না, যা শ্রীচৈতন্যদেবের স্পর্শ-পালিত বাংলার সহজিয়া সাধকদেরও মনের কথা। পরে রামকৃষ্ণের সেই বার্তাকেই করে বিবেকানন্দ বললেন- ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’, তিনি আরো বললেন- ‘জীবে সেবাই শিব সেবা’। এই আদর্শকে ভিত্তি করেই তাকে রূপায়নের জন্যে বিবেকানন্দ সূচনা করলেন রামকৃষ্ণ মিশনের। সুতরাং সমস্ত রক্ষণশীলতা ও শাস্ত্র-আলোচনাকে পেরিয়ে নতুন সময়ে এসে ধর্ম পেয়ে গেল এক নতুন দিশা, এক নতুন মানে। সেই মানেতে ধর্ম হল আর্ত-মানুষের সেবা। আসলে কথা-বার্তা দেহ-শরীর সব কিছু মানুষের মতো হলেও শ্রীরামকৃষ্ণ যেন ঠিক মানুষ নন, মানুষ হয়েও তিনি এক স্বতন্ত্র স্বত্তা। তাঁর ভিতর এক গভীর আধ্যাত্মিকতা ছিল, সঙ্গে ছিল এক মানবপ্রেম। মানুষের আধ্যাত্মিকতার মর্মস্থলটিকে তিনি ছুঁতে পেরেছিলেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন ঈশ্বরকে পাবার কোনো নির্দিষ্ট দেশ নেই কাল নেই পাত্র নেই বয়স নেই আবার ভগবৎ-অনুভূতি লাভ করার অধিকার কারো একচেটিয়া নয়। তাই জাত-ধর্ম-মত নির্বিশেষে যে কোনো মানুষকেই রামকৃষ্ণের বাণী ও শিক্ষা নিরঙ্কুশ উদবেলিত করে। ধর্মে ধর্মে মতভেদ ও কলহের উপরে উঠে রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন ধর্মনৈতিক উদারতার কথা, বলেছিলেন ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা। এক নীরব শক্তি হয়ে তিনি এই সময়ের মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনকে পরিচালিত করছেন। আসলে যে আধুনিকতার কাছে রামকৃষ্ণদেব এক জীবন্ত প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দেখা দিয়েছলেন সেই আধুনিকতা যে সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির সপক্ষে কোনো অনিবার্য ঘটনাক্রম ছিল না তা এই পোস্টমডার্ন সময়ের বিশিষ্টজনেরা স্বীকার করে নিয়েছেন। তাঁরা এটাও বুঝেছেন আধুনিকতার যেমন একটা শুরু ছিল তেমনি সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার সমপ্তিও ঘোষিত হয়েছে। মানুষের বুদ্ধিচর্চার পরিমণ্ডলে আধুনিক সময়ের অন্যতম অবদান আপেক্ষিকতাবাদ। সেই আপেক্ষিকতাবাদের মধ্যেও কিন্তু একটা বিশাল পরিহাস রয়ে গেছে। সেখানে যে কোনো ক্ষেত্রে একজনকে শ্রেষ্ঠ বলা মানে আরেকজনকে নিকৃষ্ট বলতে হবে এটা একটা প্রায় স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। এবং এটাও ঠিক, আপেক্ষিকতাবাদের এমন চর্চা বুদ্ধির সুখ পাবার ইচ্ছেকে যতই উসকে দিক বা তৃপ্ত করুক, তা কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানবিকতাকে অপমান করে। সুখের কথা এটাই, অন্তত ধর্মের ব্যাপারে এই ক্যাননটিকে ভেঙে তছনছ করে করে দিয়েছেলেন এই বাঙলারই প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেওয়া এক প্রায় নিরক্ষর মানুষ, তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি ‘যত মত তত পথ’-এর মধ্যে দিয়ে। গুরুর উচ্চারিত ধর্মের বহুবাচনিক এই বার্তাটিকেই স্বামী বিবেকানন্দ বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং পরিবেশন করেছিলেন ১৮৯৩-এ চিকাগোর ধর্ম মহা-সম্মেলনে। ১৮৯৬ সালে আমেরিকা এবং ইংল্যান্ডে বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণের উপর যে বক্তৃতাগুলি দিয়েছিলেন সেখানে তিনি বলেছেন - “There never was my religion or yours, my national religion or your national religion; there never existed many religions, there is only the one. One Infinite Religion existed all through eternity and will ever exist, and this Religion is expressing itself in various countries, in various ways.” সুদূর অতীতে সমস্ত বিশ্ববাসীকে বুদ্ধদেব শুনিয়েছিলেন অহিংসা, করুণা ও মৈত্রীর বাণী, মধ্যযুগে জগতের আপামর মানুষকে শ্রীচৈতন্যদেব বিলিয়েছেন অকাতর-প্রেম আর এই সময়ের বিশ্বসভ্যতাকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব শেখালেন পরধর্মমত সহিষ্ণুতা। এই পোস্টমডার্ন কালখণ্ডে যে কোনো নতুন ধর্ম-চেতনার ভূমিকা করতে হলে এই কথাগুলি মনে রাখাটা অবশ্যই জরুরি নয় কি ?