Free Essay

Matir Moyna

In:

Submitted By shamimtanvir
Words 2309
Pages 10
একজন তারেক মাসুদ : একটি মাটির ময়নার ব্যবচ্ছেদ http://mukhomukhoshmag.com/2013/12/16/the-clay-bird/ ফিরোজ আহমেদ
মাটির ময়না ছবিটিকে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বা দ্বিমাত্রিকতার পর্দা-উপস্থাপনে যেমন দেখা গেছে সবমিলিয়ে তা একটি নিটোল গতির, প্রকৃতিঘনিষ্ঠ, শব্দনিষ্ঠ, দৃষ্টিনন্দন ছবি। তারপরও সিনেমাবোদ্ধা কেউ হয়ত আলোচনা করার মত ত্রুটি-বিচ্যূতি তাতে খুঁজে পেতে পারেন। তবে দৈর্ঘ্যপ্রস্থের মাত্রায় “মাটির ময়না” তে কী আছে আর কী নেই তার চাইতে বরং মাটির ময়নার গভীরতায় কী বক্তব্য আছে সেদিকে দৃষ্টি দিলেই আমরা বুঝতে পারব একজন তারেক মাসুদের কেন প্রয়োজন ছিল আমাদের।
মাটির ময়না মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ভিত্তিক ছবি- সাধারণ্যে এমনটাই প্রচার পেয়েছে এবং বেশীরভাগ দর্শক সে আলোকেই ছবিটিকে বিচার করে সন্তুষ্টি উপভোগ করেছেন। কিন্তু এটি ছবিটির বহুস্তরী গভীরতার উপরিস্তর মাত্র। তারেক মাসুদের সফলতার এটা একটা কারণ যে, তিনি মাটির ময়নার বক্তব্যকে বহুস্তরে প্রক্ষেপিত করতে পেরেছেন। সাধারণ দর্শকশ্রেণী তাদের ব্যস্ত জীবনের স্বল্প অবসরে দৃষ্টিনন্দন, শ্রুতিসুখকর, শৈশবগামী কিন্তু আবার দেশের জন্য আত্মোৎসর্গের সর্বব্যাপী আবেগে জারিত নিখুঁত একটি পর্দাপরিস্ফূটন দেখে খুশি হয়েছেন। অগ্রসর দর্শকশ্রেণী আর একধাপ এগিয়ে ছবিটিতে খুঁজে পেয়েছেন একটি দেশের জন্মলগ্নে সে দেশের গর্ভে উত্তাল আলোড়ন কীভাবে সৃষ্টি হয়ে কোথা দিয়ে চূড়ান্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় সেই চিত্র। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কীভাবে একটি গহন, গভীর, নিস্তরঙ্গ গ্রাম ফুলপুরের সাধারণ মানুষের জীবন ও চেতনায় তার জন্মদাগ রেখে যায় তা দেখেছেন। বিপরীতভাবে, জন্মের কী এক দারুণ আকাঙ্খায় শিশু যেভাবে নাড়ীতে টান ফেলে, নাড়ীকে ছিন্ন করে পৃথিবীতে মুক্ত হয় সেভাবেই বাংলাদেশের কত গহন গর্ভে বসবাসকারী কতশত নিতান্ত সাধারণ মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাটি নাড়ীভেদী টান হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের জন্ম দেয়- এ সবই ‘মাটির ময়না’য় সৎ-সুন্দর প্রচেষ্টায় ধরা আছে।
প্রথম বিচারে মাটির ময়না মুক্তিযুদ্ধের ছবি সে কথায় সন্দেহ নেই। বাংলার মানুষের ন্যায্য চাওয়া পাওয়ার দাবী কীভাবে শেষপর্যন্ত সম্মুখ সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যায় ছবিতে তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। অন্যপক্ষে, চেতনায় গেড়ে বসা ধর্মীয় গোঁড়ামী কীভাবে স্ত্রী-সন্তান, পরিজন, এমনকি নিজের ব্যক্তি স্বাত্যন্ত্রবোধ, নাগরিক অধিকারবোধ ইত্যাদি সমস্ত কিছুকে ধর্মীয় বিধিবদ্ধতার কাছে বিসর্জন দিতে শেখায় তা দেখা যায়। এভাবে মাটির ময়না ছবিটিতে মুক্তিযুদ্ধ একটি বড় উপাদান হয়ে উঠেছে কিন্তু এটিই ছবির শেষ কথা নয়। একজন তারেক মাসুদের মাটির ময়না’য় অধিকতর কিছু থাকা সম্ভব; বিশেষ করে, যখন ছবির গল্পটি আত্মজৈবনিক। একজন তারেক মাসুদ, যিনি শিল্পসুষুমামন্ডিত এমন সুন্দর একটি ছবি নির্মাণ করতে পারেন- ছবিটির ছোট ছোট দৃশ্যের মধ্য দিয়ে, মুহুর্তের ঝলক সৃষ্টির মধ্য দিয়ে দর্শকের সামনে ভাবনার বিপুল দিগন্ত মেলে ধরতে পারেন তিনি তাঁর আত্মজৈবনিক গল্পে গভীরতর কোন বক্তব্য রেখে যাবেন এমনটাই স্বাভাবিক। গভীরতর বিবেচনায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মাটির ময়না ছবিটির পটভূমি মাত্র। এ বিরাট ক্যানভাসের বিপরীতে তারেক মাসুদ এক সূক্ষ জীবন চেতনার ছবি এঁকেছেন।
তারেক মাসুদের মাটির ময়না’র অন্তর্ভাগে রয়েছে প্রাণধর্মের প্রকাশ-বিকাশের কথা। জগতের সব ধর্ম, সংস্কার, মতবাদ সমস্ত কিছুকে ছাড়িয়ে প্রাণধর্ম কীভাবে তার মিষ্টি কিন্তু তীব্র অঙ্কুশটি প্রবল শক্তিতে তার আপন লক্ষ্যের দিকে নিশ্চিতভাবে চালিয়ে দেয় এ ছবিতে তারেক মাসুদ তা-ই তুলে ধরেছেন নিজের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতায়। অতএব, তারেক মাসুদকে বুঝতে হলে তাঁর মাটির ময়না-কে বুঝতে হবে। আর মাটির ময়না-কে বুঝতে হলে আমাদেরকে দৃষ্টি দিতে হবে মাটির ময়না শিরোনামটির দিকে। ‘মাটির ময়না’ ছবিতে দু’টি দৃশ্যে আমরা নীল রংয়ের একটি মাটির ময়না পাখি দেখতে পাই। আনু ছুটিতে বাড়ী আসার সময় তার বোন আসমার জন্য মেলা থেকে কিনেছিল যে মাটির ময়না পাখিটি, আপাতঃগুরুত্বহীন সেই ময়না পাখিটির নামে কেন ছবিটির নামকরণ হল? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজলেই জানা যাবে একজন তারেক মাসুদ কেন তার সমস্ত জীবন দিয়ে “মাটির ময়না” সৃষ্টি করলেন।
আনু মেলা থেকে বোন আসমার জন্য মাটির তৈরী একটা খেলনা ময়না পাখি আনে এবং পিতার অগোচরে তা বোনকে উপহার দেয়। আনুর পিতা কাজী সাহেব ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া ব্যক্তি। যে কোন ধরনের মূর্তি গড়া কিংবা ঘরে রাখাকে তিনি অপরাধ বলে মনে করেন। এমনকি শিশুদের একটি খেলনা পর্যায়ের মাটির ময়না পাখি কাছে রাখাকেও তিনি ইসলামী অনুশাসনের খেলাফ বলে গণ্য করেন। অথচ ঐ নিস্প্রাণ মাটির ময়নাটি কীভাবে ভাইয়ের আদর-ভালবাসার প্রতীক হয়ে বোনের হৃদয়কে আনন্দ আর নির্ভরতায় ভরিয়ে দিতে পারে তা দেখার চোখ বা বুঝবার হৃদয় কাজী সাহেবের নেই। কারণ তিনি প্রাণধর্মের স্বাভাবিক প্রকাশকে পাপ বলে মনে করেন। তিনি বিশ্বাস করেন ধর্ম মানুষের প্রত্যেক পদসঞ্চালনকে যান্ত্রিক কুশলতায় এবং চরমমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞানতাই তার এ ভুল দৃষ্টিভঙ্গির কারণ। ইসলাম সম্পর্কে তার ভাসাভাসা ধারনাই তাকে একথা ভাবাতে প্ররোচিত করেছে যে, জীবনের বেদী থেকে নির্মল হাসি-আনন্দ-উচ্ছ্বাসের রস সংগ্রহ করা অন্যায় ও পাপ। তিনি একথা বোঝেন না যে, ধর্ম মানুষকে মোটাদাগের যেসব সীমানা নির্ধারণ করে দেয় সেগুলো মানুষের জন্য ভালো প্রমাণিত হতে পারে কিন্তু তাই বলে মনের সূক্ষ অনুভূতিগুলিকে ধর্মের ছাঁচের মধ্যে ফেলতে গেলে ধর্ম তখনই প্রাণসংহারী হয়ে উঠে। যেমন প্রাণসংহারী হয়েছে কাজী সাহেবের জীবনে। ধর্মীয় বাতিক কাজী সাহেবের স্বাভাবিক প্রাণধর্মের প্রকাশকে সবসময় বাধাগ্রস্ত করেছে ও পরিণামে তার নিজের জীবন ও পরিবারের সদস্যদের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে।
তারেক মাসুদের এ ছবিটিতে একদিকে দেখা যায় মাটির তৈরী একটি ময়না পাখি ভাইবোনের মধ্যকার মিষ্টি-মধুর সম্পর্কের প্রতীক ধারণ করে জীবন্ত হয়ে ওঠে। মাটির ময়নাটি যেন প্রাণ পেয়ে ভাইয়ের হৃদয় থেকে বোনের হৃদয়ে উড়ে গিয়ে বসে। আর অন্যদিকে কাজী সাহেবের ধর্মীয় বাতিকের কারণে এবং প্রাণধর্মের স্বাভাবিক প্রকাশে বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে কাজী পরিবারের জীবন্ত মানুষগুলি যেন নিস্প্রাণ এক একটি মাটির ময়না হয়ে উঠে। কাজেই মাটির ময়না তারেক মাসুদের এ ছবিটির শিরোনাম মাত্র নয় বরং একটা গোপন কোড বলা যেতে পারে। আপাতঃদৃষ্টিতে অগুরুত্বপূর্ণ একটি টুল যার উপস্থিতি সিনেমায় মাত্র কিছু সেকেন্ড অথচ সেটাই হল চলচ্চিত্রটির শিরোনাম। অতএব মাটির ময়না’র ব্যবচ্ছেদের প্রয়োজন আছে।
এ ছবিটিতে দেখা যায়, ধর্মীয় বাতিকগ্রস্ত কাজী সাহেব আবেগগতভাবে মূঢ় এবং সংবেদনহীন একজন মানুষ। স্ত্রী-সন্তানের আবেগকে বুঝবার বা প্রশ্রয় দেবার মত বোধ কিম্বা ইচ্ছা কোনটিই তার নেই। অথচ তিনি সংসার বিরাগী নন। ঘরসংসারের দায়িত্ব পালনে তিনি উদাসীন নন। ঘরসংসার-স্ত্রী-সন্তানকে তিনি ভালবাসেন। কিন্তু সমস্যা হল, তার ভালবাসাটি প্রাণধর্মের আবেগ দ্বারা পরিশীলিত নয়। স্ত্রী-সন্তানের জন্য তার ভালবাসাটি তার নিজের অহংবোধকে সন্তুষ্ট করার জন্য ভালবাসা। একজন নারীর স্বামী হওয়ার যে গরিমা কিংবা সন্তানের পিতা হওয়ার যে গরিমা সেই প্রবল গরিমাজাত আত্মকেন্দ্রিক ভালবাসা। অপরপক্ষ কী চায়, অপরপক্ষের ভাললাগা কীসে তা লক্ষ্য না করে শুধুই নিজের ইচ্ছেমত অপরপক্ষকে অধিকার করার আনন্দে তাকে ভালবাসা। স্ত্রী-সন্তানকে প্রতিপালনের গৌরবজাত ভালবাসা। ঠিক যেমন কোন শিশুর একতরফা ভালবাসা থাকে তার মাটির ময়না পাখি খেলনাটির প্রতি। এমন ভালবাসা যেখানে অপর পক্ষের ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়। অপরপক্ষকে যেখানে কোনো পুতুল বা নিস্প্রাণ খেলনা বলে মনে করা হয়। তাই মাটির ময়না-তে স্পষ্ট হয়ে উঠে এমনসব সন্তানের কষ্টের কথা যারা পিতার এই প্রকারের একপক্ষীয়, আত্মগরিমাজাত, স্বার্থবাদী ভালবাসা বা পজেসিভনেস এর শিকার। পিতা যখন কেবল পিতা হওয়ার গরিমায় বিভোর আত্মকেন্দ্রিক এক অবস্থান থেকে শিশুকে একটি মাটির ময়না হিসেবে বিবেচনা করেন এবং শিশুর সঙ্গে সেই মত আচরণ করেন তখন শিশুর কষ্ট হয়। এক্ষেত্রে, পিতার অপত্য দানের আকাঙ্খাটিই শুধু তৃপ্ত হয় কিন্তু শিশুর সঙ্গে শিশুর পিতার মনের কোন সংযোগ ঘটে না। ময়না শব্দটির মধ্যে আদরের ইঙ্গিত আছে। শিশুকে “আদরের ধন” অর্থে “ময়না” বলে অভিহিত করা হয়। কিন্তু তার পূর্বে রাখা “মাটির” শব্দটি দ্বারা শিশুকে জড়ত্বে ভূষিত করার এবং শিশুর ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এভাবে “মাটির ময়না” শব্দবন্ধটি হয়ে ওঠে পিতা-পুত্র-কন্যা কিংবা স্বামী-স্ত্রীতে সহজ সম্পর্ক রচনায় ব্যর্থতার একটি চিরন্তন মানবিক আখ্যান। শিশুকে কোনো বশীকৃত, অবোধ, ভালোমন্দজ্ঞানহীন জৈব বস্তু বলে মনে করেন যখন কোন পিতা কিংব্ কোন অগ্রজ তখনই শিশুকে মাটির ময়না করে তোলা হয়। আনু তার পিতার সামনে যতটা আড়ষ্ট, বশীকৃত ও জড়তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সেই একই শিশু প্রগতিপস্থী মিলন চাচার সঙ্গে কিংবা উদারমনস্ক ইব্রাহীম হুজুরের সঙ্গে কথাবার্তায় ও আচার আচরণে অত্যন্ত সাবলীল, প্রাণচঞ্চল, দায়িত্বশীল এবং পরিণতমনস্ক ভাব প্রকাশ করে। প্রতিটি শিশুর মধ্যেই আনন্দ, ভালবাসা, রাগ, দুঃখ, ঘৃণা, অবজ্ঞা ইত্যাদি আবেগের সংবেদন গ্রহণ করার মত সহজাত ক্ষমতা একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের সমান মাত্রায় রয়েছে। হয়ত এসব আবেগের সবগুলোই প্রকাশ করার মত সুযোগ তাদের সবসময় থাকে না। এমনকি জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মত উচ্চমানের ভালোমন্দজ্ঞানও শিশুর মধ্যে সহজাতভাবেই প্রকাশ পায়। যেমনটি দেখা যায় আনুর বন্ধু শিশু রোকনের মধ্যে। জুমা’র খুতবায় দেয়া বড় হুজুরের জিহাদী বক্তব্যের মধ্যে রোকন গভীর ষড়যন্ত্রের স্বর শুনতে পায় এবং নিজের দুই কান চেপে ধরে। একজন শিশু হিসেবে রাজনীতির সব ভাষা সে বোঝে না অথচ তার ভেতরের সহজাত জ্ঞানই তাকে বলে দেয় যে, বড় হুজুরের বক্তব্যে ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ষড়যন্ত্র আছে। তার সজ্ঞা তাকে বলে দেয় যে, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ভালো জিনিষ নয়। এভাবে মাটির ময়না-তে শিশুর বিকাশমান ব্যক্তিত্বের ধারকে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখা যায়। পাশাপাশি দেখা যায় মূঢ় ও ধর্মীয় আবেগগ্রস্ত পিতা কর্তৃক শিশুর ব্যক্তিত্বকে দলিত এবং পীড়িত করার চিত্র।
কাজী সাহেব যখন পরিবার ছেড়ে তিন দিনের জন্য বাইরে যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তখন শিশু আসমা পিতার কাছে একজোড়া লাল জুতা নিয়ে আসার আবদার জানায়। মূঢ় ও সংবেদনহীন পিতা শিশুর সে আবদারে কর্ণপাত করা কিংবা তার আবদারের জবাবে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করেন না। বাড়ি থেকে পিতার বিদায়ের সময় একটি শিশুর আবদারের কী মূল্য তা হয়ত কাজী সাহেবের ধর্মীয় অনুশাসনে লেখা নেই। পিতার সঙ্গে কন্যার এই যে মানবিক যোগাযোগের একটি চেষ্টা সেটাকে কাজী সাহেব বড়ই নির্মমভাবে অবহেলা করতে পারেন। কারণ শিশু আসমা তার কছে একটি মাটির ময়নাই বটে। কিন্তু আসমার মা জানেন শিশুর একটি ভাষিক যোগাযোগের চেষ্টাকে অগ্রাহ্য করা মোটেও মানবিক নয়। তাই তিনি আসমার পিতার পক্ষ হয়ে আসমার আবদারের জবাব দেন। এভাবেই মানবিক সম্পর্কের আকুতিকে জীবন্ত করে তোলে মাটির ময়না ছবিটি।
মানবিক সম্পর্ক রচনায় কাজী সাহেবের ব্যর্থতার ব্যাপারটিকে তারেক মাসুদ ইসলাম ধর্মের সঙ্গে অনড়ভাবে যুক্ত করে দেখাননি। ইসলাম বা ধর্ম কাজী সাহেবের মূঢ়তার একটি উপাদানমাত্র। মূল ব্যাপারটি রয়েছে কাজী সাহেবের ভুল দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে। আনুর মাদ্রাসার ইব্র্রাহীম হুজুরও ইসলাম পছন্দ মানুষ অথচ তিনি অনেক মানবিক ও জীবনঘনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি লালন করেন। অতএব, ইসলাম নয় বরং ইসলাম সম্পর্কে ভুল দৃষ্টিভঙ্গিই কাজী সাহেবকে মূঢ় এবং সংবেদনহীন করে তুলেছে। কাজী সাহেব তার মেয়ে শিশুটির লাল জুতা সংক্রান্ত আবদারের কোনো মূল্য বোঝেন না এবং মেয়ের পছন্দ অপছন্দের কোনো খবর রাখেন না। অন্যদিকে ইব্রাহীম হুজুর আনু ও রোকনের সঙ্গে গল্পপ্রসঙ্গে তার মেয়ের কথা আবেগধরা গলায় যখন বলতে থাকেন তখন কাজী সাহেব ও ইব্রাহীম হুজুরের জীবনদৃষ্টির মধ্যকার পার্থক্য ধরা পড়ে। ইব্রাহীম হুজুর তার প্রাণচঞ্চল মেয়েটির পছন্দ অপছন্দের কথা জানেন। মেয়েটি যে হিজল গাছের তলার পুকুরে হিজল ফুলে ভরা অংশটিতে ডুব দিয়ে মাথা ভরা লাল হিজল ফুল নিয়ে ভেসে ওঠে তা তিনি পরম মমতায় প্রশ্রয় দেন ও উপভোগ করেন। মেয়ের ঐরূপ দূরন্তপনার কথা বর্ণনা করার সময় কিছুটা দুশ্চিন্তাগ্রস্তও মনে হয় তাকে। অন্যপক্ষে, আসমার পিতা ছোট্ট আসমার বাড়ীর বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করে দেন মেয়ের দুরন্তপনাকে বেশরীয়তী কাজের ফর্মুলায় ফেলে। রোকনকে পুকুরে একশ ডুব দেওয়ানোর শাস্তি ইব্রাহীম হুজুরকে কষ্ট দেয়। ঐ রাতে স্বপ্নে তিনি পানিতে ডুবতে থাকা একটি শিশুর দু’টি হাত তুলে বাঁচার আকুতি দেখতে পান। হতে পারে তা রোকনের হাত অথবা বাড়িতে রেখে আসা তার মেয়ের হাত। এভাবেই ইব্রাহীম হুজুরের জীবনঘনিষ্ঠ হৃদয়বৃত্তির পরিচয় পাওয়া যায়। ইসলামপছন্দ মানুষ ইব্রাহীম হুজুর ইসলামের ব্যাখ্যান গ্রহণ করেন সবসময় স্বাভাবিক জীবনাবেগের পক্ষে। ইব্রাহীম হুজুর ধর্মকে গ্রহণ করেন জীবনে এগিয়ে চলার পক্ষে, ফলে ইসলাম ইব্রাহীম হুজুরের জীবনকে পরিশীলিত করে। অন্যদিকে কাজী সাহেব ধর্মকে গ্রহণ করেন জীবনাবেগের বিপক্ষে ফলে তিনি ধর্মের কাছে হয়ে ওঠেন মাটির ময়না ।
শেষ পর্যন্ত দেখা যায় কাজী সাহেব নিজেই একটি মাটির ময়না। তিনি ধর্মের কাছে মাটির ময়না এবং রাষ্ট্রের কাছেও একটি অতিবিনীত মাটির ময়না। রাষ্ট্রের কাছে তার কোনো দাবী দাওয়া নেই। রাষ্ট্র তাকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেও নাগরিক হিসেবে তার কোন প্রতিবাদ নেই। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবেও তিনি অতিবশীকৃত এবং জড় ধরনের মানুষ। গ্রামে গ্রামে মিলিটারী ঢুকে পড়েছে এমন খবরে তিনি বিচলিত হন না, নাগরিক হিসেবে তার ব্যক্তিত্ববোধ আহতও হয় না। কারণ তিনি ধর্মের কাছে ও রাষ্ট্রের কাছে মাটির ময়না হয়ে উঠেছেন। মিলিটারী তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে গেলেও পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি তার আনুগত্যের কিংবা তার কেতাবি বোধবুদ্ধির কোন পরিবর্তন হয় না। তিনি যেন একটি শিশুর খেলনা মাটির ময়না, খেলা শেষে যাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেও ময়নাটির কিছু এসে যায় না। এভাবে মাটির ময়না কাজী সাহেবের জড়তা, বশ্যতা ও মূঢ়তাকে প্রতীকায়ন করে। কাজী সাহেব পাকিস্তান রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নিজে যেহেতু একজন বশীকৃত, জড় এবং মূঢ় ব্যক্তি তাই তিনি পরিবারের প্রধান হিসেবেও পরিবারের সদস্য ও পোষ্যদের নিকট থেকেও একই প্রকারের শর্তহীন বশ্যতা আশা করেন। তিনি নিজের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার অবস্থান থেকে বিচ্যূত হওয়ার ভয়ে পরিবারে তার পোষ্যদের সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক এড়িয়ে চলেন। তিনি তার পুত্রের ব্যাপারে পুত্রের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন না পুত্রের ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার করার জন্য এবং নিজের ব্যক্তিত্বের ওজন হারানোর ভয়ে। পুত্রের ব্যাপারাদি নিয়ে শাসন-ভাষণ সমস্ত কিছু করেন পুত্রের মায়ের সঙ্গে ঠিক যেমনটি করেছে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকশ্রেণী পূর্ব-পাকিস্তানের বিষয়াদি নিয়ে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা এড়িয়ে অন্যভাবে শাসনের স্পর্ধা দেখিয়ে। এভাবে নানা মাত্রায় নানা স্তরে “মাটির ময়না” হয়ে উঠেছে একটি জীবনসূত্র।
কোন সম্পর্কের মধ্যে যখন পারস্পারিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার নীতি মানা হয় না তখন সে সম্পর্কটি বিষময় হয়ে যায়। এক পক্ষ যখন অপর পক্ষের ব্যক্তিত্বকে স্বীকার করে না, অপরপক্ষের প্রতি শ্রদ্ধা রাখে না, অপর পক্ষের মতামতকে মূল্য দেয় না তখন সে সম্পর্ক আর টিকিয়ে রাখা যায় না। এই জীবনসূত্রটি যেমন আমাদের আটপৌরে ব্যক্তি জীবনের ক্ষেত্রে সত্য একইভাবে তা রাষ্ট্রীয় জীবনের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য। কাজী সাহেব যেমন স্ত্রী-সন্তান-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন তেমনি পাকিস্তান রাষ্ট্রও তার পূর্ব-অংশের সঙ্গে সৎ-সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে শ্রদ্ধাবোধ ও বোঝাপড়ার নীতিটি অস্বীকার করার কারণে। পশ্চিম পাকিস্তান চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকে একটি মাটির ময়না করে রাখতে। কিন্তু যে প্রাণধর্ম প্রবল শক্তিতে তার আপন পথ করে নেয় সেই প্রাণধর্মের আবেগ এবং শক্তিই নিশ্চিত লক্ষ্যপানে তার অঙ্কুশ চালিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ নামের দেশটির। অতএব, প্রাণধর্মের স্বাভাবিক ও অব্যাহত প্রকাশকে সমর্থন দিতেই তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছেন মাটির ময়না ছবিটি। এই প্রাণধর্মের প্রকাশ দেখা যায় মিলন, করিম মাঝি, ইব্রাহীম হুজুরের মধ্যে। প্রাণধর্মের ছাইচাপা আগুন জেগে থাকে কাজী সাহেবের স্ত্রীর মনে। আর প্রাণধর্ম ভবিষ্যতের জন্য সম্ভাবনার ইঙ্গিত জাগিয়ে রাখে আনু-রোকনের মধ্যে। ছবির শেষভাগে আনু তার পিতার কোমর জড়িয়ে ধরে বারবার অনুরোধ করে তাদের সঙ্গে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে। কিন্তু সে অনুরোধে কোন ভাবান্তর হয় না কাজী সাহেবের মধ্যে। তখন পিতা সম্পর্কে আনু এক নতুন উপলব্ধিতে পৌঁছে। আনুর কপালে চিন্তার রেখা এবং চোখে দূর্বিনীতি দৃষ্টি দেখা যায়। দূর্বিনীতি দৃষ্টিতে সে পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সম্ভবতঃ তখন পিতার সঙ্গে তার সম্পর্কটি একটি নতুন মাত্রা লাভ করে যেখানে সে পিতাকে জীবনযুদ্ধে পরাজিত পলায়নপর একজন মানুষ হিসেবে আবিস্কার করে। পরের দৃশ্যে আনুর মা আনুর হাত ধরে অজানিতের পথে পা বাড়ান। উঠান পেরিয়েই সামনে দৃষ্টিতে ধরা পড়ে আসমার কবর। আনু ও তার মা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায়। ছবিটি এখানেই শেষ হয়। পিতার একগুঁয়েমিতে আসমার মৃত্যু, যুদ্ধে মিলনের মৃত্যুর বেদনা আর প্রিয় স্বামী-সংসার হারানোর আংশকা ইত্যাদি সমস্ত কিছুকে পেছনে ফেলে আনুর মা’র জীবন সামনে এগিয়ে যাবে প্রাণধর্মের তাগিদেই। প্রাণধর্মের তাগিদেই সামনে এসে গেছে মুক্তির যুদ্ধ। ছবিটির সমাপ্তি প্রশ্ন রেখে যায়,কাজী সাহেব কী যাবেন আনুদের সঙ্গে?
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে মাটির ময়না একটি মাইল ফলক হিসেবে থেকেই যাবে। এর চিরন্তন আবেদন ফুরাবে না কখনও। যদি আমাদের প্রাণধর্মের বেগ কমে আসে, যদি চেতনা মূঢ়তায় আচ্ছন্ন হতে চায় তখনই আমরা মাটির ময়না ছবিটি দেখতে চাইতে পারি মুক্তির জন্য। চাইতে পারি একজন তারেক মাসুদের জন্ম যেন বারবার হয় এদেশে।

Similar Documents

Premium Essay

History of Indian Sub Continent

...PAPER 28 THE HISTORY OF THE INDIAN SUBCONTINENT FROM THE LATE EIGHTEENTH CENTURY TO THE PRESENT DAY READING LIST: 2012-13 C. A. Bayly cab1002@cam.ac.uk 1 The History of The Indian Subcontinent From The Late Eighteenth Century To The Present Day A fifth of the world's population lives in the Indian subcontinent. While today the region’s place in the global world order is widely recognised, this is in fact only the most recent chapter in a longer history. This paper offers an understanding of the part played by the Indian subcontinent role and its people in the making of the modern world. From the decline of the great empire of the Mughals and the rise of British hegemony, to the rise of nationalism, the coming of independence and partition, the consolidation of new nation states despite regional wars and conflicts, and the emergence of India as the largest democracy in the world, this paper is a comprehensive and analytical survey of the subcontinent's modern history. The dynamic and complex relationships between changing forms of political power and religious identities, economic transformations, and social and cultural change are studied in the period from 1757 to 2007. In normal circumstances students will be given 6 supervisions in groups of 1 or 2. Key themes and brief overview: The paper begins by examining the rise of British power in the context of economic developments indigenous to southern Asia; it analyses the role played by Indian polities and social groups...

Words: 11803 - Pages: 48

Free Essay

Public Administration

...SL 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 Song Name Amanush Theme Amanush Duchokher Oi Jhiley Hai Rama Jiboner Jalchabi Monta Kore Uru Uru O My Love Aamake Aamar Moto Thaakte Dao Bhaage Jaana Hai Kahan Bneche Thakar Gaan (Rupam) Bneche Thakar Gaan (Saptarshi) Chawl Raastaye (Shreya) Chawl Raastaye (Priyam) Phnaade Poriya Bawga Knaade Re Uthche Jege Shawkalgulo Bol Na Aar Dui Prithibi It's Only Pyaar O Yara Vey Pyarelal Keno Aaj Kal Keu Mone Mone Khujechi Toke Raat Berate Pirit Koro Na Sexy Maye Aas Paas Hai Khuda (Unplugged) Aas Pass Hai Khuda Ale Ab Jo Bhi Ho Anjaana Anjaani Hai Magar Anjaana Anjaani Ki Kahani Apna Har Din Jiyo (Remix) Apna Har Din Jiyo Baki Main Bhool Gayi Chhan Ke Mohalla Sara (Remix) Chhan Ke Mohalla Sara Chori Kiya Re Jiya (Female) Chori Kiya Re Jiya (Male) Dabangg Theme Desi Kali Your A Desi Kali (Bawara Sa) (Remix) Desi Kali Your A Desi Kali (Bawara Sa) Desi Kali Your A Desi Kali (Remix) Song Code 5551 5552 5553 5554 5555 5556 5557 5558 5559 55510 55511 55525 55512 55513 55514 55515 55516 55517 55518 55519 55520 55521 55522 55523 55524 55526 55527 55528 55529 55530 55531 55532 55533 55534 55535 55536 55537 55538 55539 55540 55541 Artist/Movie/Album Amanush Amanush Amanush Amanush Amanush Amanush Amanush Autograph Autograph Autograph Autograph Autograph Autograph Autograph Autograph Dui Prithibi Dui Prithibi Dui Prithibi Dui Prithibi Dui Prithibi Josh Josh Josh Josh Josh...

Words: 100551 - Pages: 403